বাংলাদেশে ২০২৫ সালে ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করবেন কিভাবে ?



ভূমিকা: গল্পটা সবার মতো ছিল না

রাত ১টা। শহরের ছোট্ট একটা রুমে একটা ছেলে ল্যাপটপে বসে ইউটিউব দেখছে। গায়ের গরম ভ্যানের বাতাস, মশার কামড়, মাথার ভেতরে চিন্তা—“আমি কিছু একটা করবো, কিন্তু কীভাবে?”

ছেলেটির নাম রাফি। বাবা পেশায় গাড়ি চালক। মাসে ১৫ হাজার টাকায় সংসার চলে না। চাকরি পায়নি। ব্যবসার টাকা নেই। কিন্তু তার ইন্টারনেট আছে। চোখে স্বপ্ন আছে।

সেই রাতেই সে প্রথম জানতে পারে “ড্রপশিপিং” নামে এক জাদুমন্ত্রের কথা।


ড্রপশিপিং কী?

ড্রপশিপিং হলো এমন এক ব্যবসা মডেল, যেখানে আপনি নিজে পণ্য হাতে না রেখেই অনলাইনে বিক্রি করতে পারেন। পণ্য আপনার না, গুদামে নেই, তারপরও আপনি সেটা বিক্রি করছেন এবং লাভ করছেন।

কাজের প্রক্রিয়াটি কীভাবে হয়?

  1. আপনি একটি অনলাইন শপ তৈরি করবেন।
  2. সেখানে বিভিন্ন প্রোডাক্ট তালিকাভুক্ত করবেন — যেগুলো অন্য কোনো সাপ্লায়ারের স্টকে আছে।
  3. যখন কোনো কাস্টমার আপনার ওয়েবসাইটে অর্ডার করবে, তখন আপনি সেই অর্ডারটি সরাসরি সাপ্লায়ারকে পাঠাবেন।
  4. সাপ্লায়ার পণ্যটি কাস্টমারের ঠিকানায় পাঠাবে।
  5. আপনি মূলদামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করে মাঝের মুনাফাটা তুলে নেবেন।

কেন ২০২৫ সালে বাংলাদেশে ড্রপশিপিং শুরু করাটা গুরুত্বপূর্ণ?

  • ই-কমার্সে অভূতপূর্ব উত্থান: ২০২৫ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স সেক্টর প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মানুষ এখন বাড়িতে বসেই কিনতে চায়।
  • লোকাল ও গ্লোবাল বাজার: আপনি চাইলে শুধু বাংলাদেশে না, আন্তর্জাতিক মার্কেটেও পণ্য বিক্রি করতে পারেন।
  • পুঁজি ছাড়া ব্যবসা: গুদাম নেই, পণ্য কেনার দরকার নেই। শুধু একটি ওয়েবসাইট আর সঠিক স্ট্র্যাটেজিই যথেষ্ট।

কিভাবে শুরু করবেন? (Step-by-Step Roadmap)


🔹 ১. নির্দিষ্ট একটি নিস (Niche) বেছে নিন

সবকিছু বিক্রি করা যাবে না। নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য গ্রাহক নির্ধারণ করুন। উদাহরণ:

  • স্কিন কেয়ার (ছাত্রীরা বেশি আগ্রহী)
  • ইসলামিক প্রোডাক্ট (রোজার সময় চাহিদা বাড়ে)
  • ব্যাগ, ঘড়ি, গিফট আইটেম
  • হোম ডেকোর বা বাচ্চাদের খেলনা

🔹 ২. আপনার ব্র্যান্ডের নাম ও লোগো ঠিক করুন

একটি সুন্দর, স্মার্ট নাম এবং আকর্ষণীয় লোগো আপনাকে ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।

উদাহরণ:

  • GiftHouseBD
  • HijabHeaven
  • TechCartBD

🔹 ৩. একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করুন

ড্রপশিপিংয়ের জন্য পেশাদার ওয়েবসাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Shopify, WooCommerce (WordPress) বা Wix ব্যবহার করতে পারেন।

যা যা দরকার হবে:

  • একটি .com বা .bd ডোমেইন
  • হোস্টিং সার্ভিস
  • ভালো একটি থিম
  • প্রোডাক্ট পেইজ
  • কাস্টমার রিভিউ অপশন
  • চ্যাট সাপোর্ট

🔹 ৪. নির্ভরযোগ্য সাপ্লায়ার বাছাই করুন

আপনার সাপ্লায়ার হতে পারে দেশি বা বিদেশি। তবে সঠিকভাবে ডেলিভারি দিতে পারে এমন সাপ্লায়ারই বেছে নিন।

বিদেশি সাপ্লায়ার:

  • AliExpress
  • CJ Dropshipping
  • Spocket
  • Zendrop

দেশি সাপ্লায়ার:

  • Facebook dropshipping group
  • Local wholesale market (চাঁদনী চক, গুলিস্তান, নিউ মার্কেট)

🔹 ৫. পেমেন্ট গেটওয়ে সেটআপ করুন

গ্রাহকের কাছ থেকে পেমেন্ট নেওয়ার জন্য নিচের গেটওয়েগুলো ব্যবহার করতে পারেন:

  • SSLCommerz
  • Bkash Checkout Integration
  • Nagad API
  • Cash on Delivery (COD)

🔹 ৬. মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ঠিক করুন

একটা ভালো প্রোডাক্টও কেউ কিনবে না যদি আপনি তাকে চিনিয়ে না দেন।

কাজের প্ল্যাটফর্ম:

  • Facebook Page ও Ads
  • TikTok ভিডিও মার্কেটিং
  • Instagram reels
  • WhatsApp Broadcast
  • Influencer Marketing

মার্কেটিং কৌশল:

  • সমস্যা তুলে ধরুন → প্রোডাক্ট দিন সমাধান হিসেবে
  • কাস্টমার রিভিউ শেয়ার করুন
  • Facebook গ্রুপে organically পোস্ট দিন

ব্যক্তিগত যাত্রা: রাফির গল্প

রাফি মাত্র ৭৫০০ টাকা দিয়ে একটা WordPress ওয়েবসাইট বানায়। সে ১৫ দিনে কোনো সেল পায়নি। হতাশ হয়ে পড়ে। একদিন সে একটা Reels ভিডিও বানিয়ে TikTok-এ পোস্ট করে—মায়ের জন্মদিনে কী গিফট দেওয়া যায়, এমন একটা গল্পভিত্তিক ভিডিও।

সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। একদিনেই ৫০টা অর্ডার আসে।

রাফির চোখে পানি চলে আসে। কারণ এই অর্ডার মানে কেবল টাকা নয়, এই অর্ডার মানে তার স্বপ্নের প্রথম ধাপ।


বাংলাদেশি ড্রপশিপিংয়ে চ্যালেঞ্জ যা আপনাকে জানতেই হবে

⚠️ ডেলিভারি টাইম বেশি (বিদেশি সাপ্লায়ার হলে)

সমাধান: আগে থেকেই জানিয়ে দিন। দেশি সাপ্লায়ার বেছে নিন।

⚠️ Facebook Ads রিজেক্ট হতে পারে

সমাধান: Facebook-এর Ad Policy পড়ুন। নিজের কনটেন্ট ইউনিক রাখুন।

⚠️ পেমেন্ট কনভার্সন সমস্যা

সমাধান: দেশি গেটওয়ে ব্যবহার করুন (Bkash, SSLCommerz)। Google Pay/Stripe দরকার হলে পেমেন্ট এজেন্সি ব্যবহার করতে পারেন।

⚠️ প্রোডাক্ট কপি করে অন্যে বেশি সেলে চলে যেতে পারে

সমাধান: ব্র্যান্ডিং করুন, ইউনিক গল্প দিন, নিজের ভিডিও বানান।


যা যা মাথায় রাখবেন ব্যবসা শুরু করার আগে

  • আপনার গ্রাহক কে, সেটা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করুন
  • পণ্যের ছবি ও ভিডিও নিজের মতো করে তৈরি করুন
  • পণ্যের দাম নির্ধারণে সময় নিন
  • গ্রাহকের প্রতি আন্তরিক থাকুন
  • রিটার্ন পলিসি ও কাস্টমার সাপোর্ট পরিষ্কার রাখুন

অনুপ্রেরণা: আপনি পারবেন

যদি আপনি এখনো মনে করেন — “আমার তো টাকা নেই”,
মনে রাখবেন: রাফির মতো হাজারো তরুণ এখন ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় করছে শুধুমাত্র ঘরে বসে ড্রপশিপিং করে।

শুরুটা একটু কঠিন, হয়তো রাত জেগে কাজ করতে হবে, অনেকে বলবে—”কাজটা কাজ না”, কিন্তু একদিন, আপনিই অন্যদের শেখাবেন কীভাবে শুরু করতে হয়।


উপসংহার: এখনই সময়

ড্রপশিপিং শুধু একটা ব্যবসা না, এটা একটা সুযোগ—আপনার সময়, শ্রম, স্বপ্ন দিয়ে কিছু তৈরি করার উপায়।
২০২৫ সাল এই ব্যবসার জন্য একটা সোনালী সময় হতে পারে, যদি আপনি সঠিকভাবে শুরু করেন।

আজই আপনার প্রথম ধাপ নিন।
একটা ডোমেইন কিনুন, একটা নাম ঠিক করুন, এবং নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন।


লেখা: তানজিম আহমেদ
ডিজিটাল উদ্যোক্তা | বাংলা ব্লগার | ব্যবসা শেখানোর গল্পকার


আপনি যদি চান আমি পরের পোস্টে ড্রপশিপিং ওয়েবসাইট বানানোর টিউটোরিয়াল বা Facebook অ্যাড সেটআপ নিয়ে লিখি, বলুন আমি সেটাও করে দেবো।

আর পোস্টটির একটা ডিজাইন করে দিতে চাইলে তাও জানাতে পারেন।


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *